সুলায়মান ইব্নু ইয়াসার (র) থেকে বর্ণিতঃ
রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবদুল্লাহ ইব্নু রাওয়াহাকে খায়বরে প্রেরণ করতেন। তিনি তথাকার বাগানের ফলের পরিমাণ নির্দিষ্ট করতেন। একবার ইহুদীরা তাদের স্ত্রীদের অলংকার একত্রিত করে আবদুল্লাহকে দিতে চাইল আর ইহুদীরা বলল, আপনি এই অলঙ্কার গ্রহণ করুন আর পরিমাণে কিছু হ্রাস করুন। আবদুল্লাহ্ বললেন, হে ইহুদী সম্প্রদায়! আমি আল্লাহ্র সমস্ত সৃষ্ট বস্তুর মধ্যে তোমাদেরকে নিকৃষ্ট মনে করে থাকি, তা সত্ত্বেও আমি তোমাদের উপর জুলুম করতে চাই না। তোমরা আমাকে যে উৎকোচ দিচ্ছ এটা হারাম, ইহা আমরা খাই না। ইহুদীরা বলতে লাগল, এইজন্যই এখনও পৃথিবী ও জমি স্থির রয়েছে। [১] (হাদীসটি ইমাম মালিক এককভাবে বর্ণনা করেছেন)
মালিক (র) বলেন যদি কেউ সেচ ব্যবস্থা আঞ্জাম করবে এই শর্তে কোন খেজুর বাগান নেয় এবং ঐ বাগানের খালি জমিতে কিছু বপন করে, তবে উহা তারই হবে। যদি বাগানের মালিক এই শর্ত লাগায় যে, আমি উহাতে চাষ করব তবে উহা বৈধ হবে না। কেননা সেচের ব্যবস্থাপক ব্যক্তি খেজুর গাছে পানি দেবে যাতে তার জমিও সেচের আওতায় এসে যাবে আর তার চাষ করা অবৈধ। হ্যাঁ, যদি ঐ চাষ উভয়ের মধ্যে শরীকী হয়, তবে বৈধ হবে যখন শ্রম, বীজ, রক্ষণাবেক্ষণ সেচ শ্রমিকের উপর থাকবে। মালিকের শুধু জমি থাকবে। যদি শ্রমিক জমির মালিকের উপর এই শর্ত আরোপ করে যে, আপনি বীজ দিবেন এটা বৈধ নয়, কেননা সেচ ব্যবস্থা শুধু ঐ অবস্থায় বৈধ হবে যখন সমস্ত কিছুই শ্রমিকের যিম্মায় থাকবে। মালিকের শুধু জমি থাকবে। এটাই মুসাকাতের প্রচলিত ও বৈধ পন্থা।
মালিক (র) বলেন একটি কূপের দুই ব্যক্তি সমান সমান মালিক। কূপটিতে পানি রইল না। একজন উহা ঠিক করতে চাইলে অন্য ব্যক্তি মানল না, আমার নিকট টাকা নাই, আমি খরচ দিতে পারব না। এমতাবস্থায় যে উহা ঠিক করতে চেয়েছে তাকে উহা ঠিক করতে দেয়া হবে। সমস্ত পানি তারই হবে, আর সেই পানি ব্যবহারের পূর্ণ অধিকার তারই হবে। অপর ব্যক্তি খরচের অর্ধেক শোধ করলে সে তাতে অংশগ্রহণ করবে। প্রথম ব্যক্তিকে পূর্ণ পানি এইজন্য দেয়া হবে যে, সে সব খরচ বহন করেছে। যদি পানি না হত তবে অপর ব্যক্তি খরচের কিছুই দিত না; প্রথম ব্যক্তির অর্থ ব্যয় বৃথা যেত।
মালিক (র) বলেন যদি বাগানের মালিকের উপর সকল প্রকার ব্যয়ের দায়িত্ব থাকে, শ্রমিকের উপর ব্যয়ের কোন দায়িত্ব না থাকে, তার যিম্মায় থাকে কেবল শ্রম। আর তাকে শ্রমের পরিবর্তে কিছু ফল দেয়া হয় তবে এটা অবৈধ, কেননা শ্রম অনির্দিষ্ট, বাগানের মালিক তার পারিশ্রমিক নির্দিষ্ট করে না দিলে সে অবগত নয় যে তার পারিশ্রমিক কতটুকু। ফলের উৎপাদন বেশিও হতে পারে, কমও হতে পারে।
মালিক (র) বলেন যে ব্যক্তি শরীকী কারবারে ধন দেয় বা সেচের বিনিময়ে বাগান শরীকানায় দেয় তার জন্য এটা বৈধ নয় যে, সে নিজের জন্য অর্থ বা কতিপয় নির্দিষ্ট করে এবং বলে যে এই পরিমাণ অর্থ যেমন দশ দীনার বা অমুক গাছের ফল আমারই জন্য থাকবে, উহাতে শরীকানা নাই, বৈধ নয়। আমাদের নিকট মাসআলা অনুরূপই।
মালিক (র) বলেন আমাদের মধ্যে প্রচলিত নিয়মানুযায়ী বাগানের মালিক সেচ শ্রমিকের উপর নিম্নলিখিত শর্ত আরোপ করতে পারে ; ১। বাগানের প্রাচীর ঠিক করতে হবে; ২। পানির কূপ পরিষ্কার করতে হবে; ৩। বাগানের সেচের নহরগুলো পরিষ্কার রাখবে; ৪। গাছে নর-মাদীর মধ্যে সংযোগ স্থাপন করবে; ৫। ছিলা চাঁছার কাজ করবে; ৬। গাছের খেজুর পেড়ে আনবে ইত্যাদি কাজ, যদি মালিক শ্রমিক উভয়ে সম্মত হয়। গাছের মালিকের ইচ্ছাধীন থাকবে সে শ্রমিকের জন্য অর্ধেক ফল বা কম ও বেশি যেভাবে কথা থাকে যদি উভয়ে উহাতে সম্মত থাকে নির্ধারিত করতে পারে। গাছের মালিকের এই অধিকার থাকবে না যে, সে শ্রমিকের প্রতি নতুন কিছু বানাতে শর্ত করবে যেমন কূপের চতুষ্পার্শ্বে উঁচু বেঁধে কূপ খনন করা না নতুন গাছ লাগানো বা খাল খনন করা বা এজন্য পানির হাউজ বানানো, যাতে বাগানের আয় বেড়ে যায়।
মালিক (র) বলেন উহার উদাহরণ এই যে, বাগানের মালিক কাউকেও বলল, আমার জন্য ঘর তৈরী কর বা কূপ খনন কর কিংবা জলাশয় পরিষ্কার কর কিংবা অনুরূপ কোন কাজ কর যার পরিবর্তে আমি বাগানের অর্ধেক ফল দিয়ে দেব অথচ ফল খাওয়ার উপযুক্ত হয়নি, না এখনও উহার পাকার সময় হয়েছে ইহা বৈধ নয়। কেননা এটা ফল উপযুক্ত হওয়ার পূর্বে বিক্রি করার মতো রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটা হতে নিষেধ করেছেন।
মালিক (র) বলেন যদি ফল খাওয়ার উপযুক্ত হয় এবং উহার বিক্রয় বৈধ হয়, সে সময় কোন ব্যক্তি অপর এক ব্যক্তিকে বলল, তুমি আমার অমুক অমুক কাজ কর। সে কাজ নির্দিষ্ট করে বলল, তোমার কাজের বিনিময়ে আমি তোমাকে আমার এই বাগানের অর্ধেক ফল প্রদান করব, এটা বৈধ। কারণ এই লোকটিকে নির্দিষ্ট পারিশ্রমিকের উপর মজুর হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে; সে উহা দেখে তাতে সম্মতি প্রদান করেছে। কিন্তু মুসাকাত বৈধ হয় যদিও বাগানের ফল উৎপন্ন না হয়, অথবা স্বল্প উৎপাদন হয় অথবা নষ্ট হয়ে যায়। মুসাকী বা সেচের ব্যবস্থাকারীর জন্য এটাই প্রাপ্য হবে। পক্ষান্তরে কাউকেও শ্রমে নিযুক্ত করা হলে নির্দিষ্ট পারিশ্রমিকের উপর নিযুক্ত করতে হয়, এটা ছাড়া শ্রমে খাটানো বৈধ নয়। কারণ ইজারা এক প্রকার ক্রয়-বিক্রয়ের মতো। তাতে শ্রমিকের শ্রম ক্রয় করা হয়। তাতে ধোঁকার প্রবেশ ঘটলে এটা বৈধ হয় না। কেননা রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধোঁকার ক্রয়-বিক্রয় হতে নিষেধ করেছেন।
মালিক (র) বলেন আমাদের মতে প্রত্যেক প্রকার ফলের গাছের ব্যাপারে মুসাকাত জায়েয আছে। যেমন আঙ্গুর, খেজুর, যায়তুন, তীন, আনার বা শাফ্তাল ইত্যাদি বৃক্ষ; এই শর্তে যে, বাগানের মালিক অর্ধেক, এক-তৃতীয়াংশ, এক-চতুর্থাংশ বা বেশি-কম ফল নিয়ে নিবে, অবশিষ্ট ফল শ্রমিকের থাকবে।
মালিক (র) বলেন শস্যক্ষেত্রেও মুসাকাত বৈধ। শস্য মাটি ভেদ করে বাহির ও স্থির হলে এবং মালিক তার যতœ ও তত্ত্বাবধানে অক্ষম হলে সেই অবস্থায় মুসাকাত বৈধ হবে।
মালিক (র) বলেন ফল পরিপক্ক হলে এবং বিক্রয়ের উপযুক্ত হলে যেসব বৃক্ষে মুসাকাত জায়েয ছিল এই ক্ষেত্রে উহা আর বৈধ হবে না। তবে আগামী বৎসরের জন্য মুসাকাত করা যাবে। কারণ বিক্রয়ের উপযুক্ত ফলের মুসাকাত ইজারা বলে গণ্য হবে, এটা যেন ফল বিক্রয়ের উপযুক্ত হওয়ার পর বৃক্ষের মালিক শ্রমিকের সাথে চুক্তি করল উহা কেটে দেয়ার জন্য, যেমন শ্রমিককে দিরহাম বা দীনার প্রদান করা হল যার বিনিময়ে সে গাছের ফল কেটে দেবে। এটা মুসাকাত নয়। মুসাকাত হচ্ছে বিগত বৎসর হতে আগামী বৎসর ফল পরিপক্ক হওয়া ও বিক্রয়ের উপযুক্ত হওয়ার মধ্যবর্তী সময়ের জন্য যা হয় তা।
মালিক (র) বলেন যে গাছের খেজুরের উপর মুসাকাত করেছে সেই গাছের ফল পরিপক্ক হওয়া এবং বিক্রয়ের উপযুক্ত হওয়ার পূর্বে এই মুসাকাত বৈধ হবে।
মালিক (র) বলেন খালি জমিতে মুসাকাত বৈধ নয়। হ্যাঁ, দিরহাম দীনারের বিনিময়ে ভাড়ার উপর দেয়া যাবে পারে যদি কোন ব্যক্তি খালি জমি চাষের জন্য উহা হতে উৎপাদিত [২] এক -তৃতীয়াংশ বা এক-চতুর্থাংশ ফসলের উপর কাউকেও দেয় তবে বৈধ হবে না, কেননা তাতে ধোঁকা রয়েছে। ক্ষেতে ফসল হয় কিনা তা জানা নাই, ফসল হলেও কত ফসল হবে, অধিক না অল্প তাও জানা নাই।
মালিক (র) বলেন এর দৃষ্টান্ত এইরূপ, যেমন কোন ব্যক্তি কাউকেও নির্দিষ্ট কিছুর বিনিময়ের সফরে তাঁর সঙ্গে থাকবার জন্য নিযুক্ত করল। পরে তাকে বলতে লাগল, আমি এই ভ্রমণে যে লাভ করব উহার এক-দশমাংশ তোমাকে দেব, এটাই তোমার পারিশ্রমিক। তবে এটা বৈধ হবে না এবং এইরূপ করা অনুচিত।
মালিক (র) বলেন কারো জন্য নিজকে বা যমীন বা নৌকা ইত্যাদি জাতীয় কোন বস্তু যা তার নিজস্ব কিছু নির্ধারণ করা ব্যতীত কাউকেও ভাড়ায় দেয়া বৈধ নয়, নির্দিষ্ট করে ভাড়ায় দেয়া হলে তা বৈধ।
মালিক (র) খেজুর গাছ ও খালি জমি শরীকানা ব্যবস্থায় দেয়া সম্পর্কে বলেন এই দুয়ের মধ্যে পার্থক্য হল এই যে, খেজুর গাছের মালিক খেজুর খাওয়ার উপযুক্ত হওয়ার পূর্বে বিক্রয় করতে পারে না, আর জমির মালিক জমি এই অবস্থায় দিচ্ছে যে উহা খালি, তাতে কিছুই নেই।
মালিক (র) বলেন খেজুর বা এ জাতীয় গাছে দুই, তিন বা চার বৎসর অথবা বেশি বা কম বৎসরের জন্য সেচ ব্যবস্থার উপর দেয়া বৈধ। খেজুর গাছের মতো অন্যান্য বৃক্ষেও এটা বৈধ হবে, এইরূপ আহলে ইলম-এর নিকট আমি শুনেছি। [৩]
মালিক (র) বলেন মুসাকাতকারী বা বাগানের মালিক হতে শ্রমিক নিজের জন্য অতিরিক্ত কিছু খাস করে নিতে পারবে না- তা স্বর্ণ রৌপ্য হোক বা খাদ্যদ্রব্য বা অন্য কিছু হোক, এটা জায়েয নয়। অনুরূপ শ্রমিকের পক্ষেও বাগানের মালিক হতে নিজের জন্য অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করা বৈধ নয়। তা স্বর্ণ-রৌপ্য হোক বা খাদ্যদ্রব্য হোক- অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করা উভয়ের জন্য বৈধ নয়।
মালিক (র) বলেন মুকারাযা বা মুসাকাতে শর্তের অধিক কিছু চাইলে উহা ইজারা বলে গণ্য হবে। ইজারার শর্তাবলি এতে প্রযোজ্য হবে। ধোঁকার আশংকা রয়েছে এমন কিছুতে ইজারা অবৈধ। জানা নাই ফসল আদৌ হবে কিনা বা কম হবে, না বেশি হবে।
মালিক (র) বলেন যদি কেউ এইরূপ জমি মুসাকাত ব্যবস্থার উপর দেয় যাতে খেজুর, আঙ্গুর বা এ জাতীয় গাছ থাকে আবার খালি জমিও থাকে। যদি জমিতে গাছ থাকে বেশি এবং খালি জমি ১/৩ অংশ থাকে বা তার হতে কম হয় তবে সেচের উপর দেয়া বৈধ হবে।
মালিক (র) বলেন যদি খালি জমি যাতে খেজুর বা আঙ্গুরের বৃক্ষ রযেছে ২/৩ (দু-তৃতীয়াংশ) বা ততোধিক হয় তবে এইরূপ জমি ভাড়া লওয়া বৈধ হবে, সেচের উপর দেয়া বৈধ হবে না। কেননা লোকের মধ্যে এই নিয়ম রয়েছে যে জমিতে সেচের উপর দেয়া হয় তাতে খালি জায়গাও থাকে। অথবা যে তলোয়ারে চাঁদি লাগান থাকে তাতে চাঁদির পরিবর্তে বিক্রি করে দেয় কিংবা যে হার বা আংটিতে স্বর্ণ রয়েছে, উহাকে স্বর্ণের পরিবর্তে বিক্রি করে দেয় বরাবরই মানুষ এই ধরনের কারবার করে থাকে। আর এর কোন সীমা নির্দিষ্ট নাই যে, এই পরিমাণ হলে বৈধ হবে, এর অতিরিক্ত বৈধ হবে না, হারাম হবে। আমাদের মতে এই বিধান রয়েছে যে, যখন তলোয়ার ইত্যাদিতে বা আংটিতে স্বর্ণ ইত্যাদি ১/৩ অংশের মূল্যের সমান হয় বা উহা হতে কম হয় তবে উহা চাঁদি বা স্বর্ণের পরিবর্তে বৈধ হবে, অন্যথায় বৈধ হবে না।